এক দিন কাজে না গেলে চুলা জ্বলে না।
তিন জনের সংসার। মেয়ের পড়াশোনার খরচ চলে না।
গত ৪ আগস্ট সকাল ৮ দিকে বাড়ি থেকে বের হয়েছিল কাজের জন্য। কাজ শেষে দুপুরে বাড়ি ফিরবে বলেছিল।পরের দিন ফিরছে,তাও লাশ হয়ে। পেটে ও মাথায় গুলি নিয়ে।
কথা গুলো বলছিলেন,গত ৪ আগস্ট মুন্সীগঞ্জ শহরে বৈষম্য বিরোধী ছাত্রদের সঙ্গে পুলিশ আঃ লীগ,যুবলীগ,ছাত্রলীগের গুলিতে মারা যাওয়া নিহত রিয়াজুল ফরাজীর স্ত্রী রুমা আক্তার।
রিয়াজুল ফরাজী (৩৮)। তিনি মুন্সীগঞ্জ শহরের উত্তর ইসলামপুর এলাকার প্রয়াত কাজী মতিন ফরাজীর ছেলে। গত ৪ আগস্ট মুন্সীগঞ্জ শহরের সুপার মার্কেট এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।তিনি পেশায় একজন শ্রমিক ছিলেন।সেদিন কাজে বের হয়েছিলেন।গোলাগুলিতে পরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তিনি।রিয়াজুল ছিলেন তিনজনের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।
রুমা আক্তার বলেন,খুব অল্প বয়সে আমাগো বিয়া হইছিল।আমি নিজে হার্টের রোগী।একটা মাইয়া ধার দেনা কইরা বিয়া দিছি।দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া আরো একটা মাইয়া অবিবাহিত আছে।আমার ওষুদ খরচ,মেয়ের পড়ার খরচ,সংসার খরচ চালাইতে যখন যে কাজ পাইতো তাই করতো।কখনো অলস বইসা থাকতো না।সে দিন(৪ আগস্ট) বাড়ি থেকে বেড় হওয়ার সময় বলেছিল,চিন্তা করিস না আমাগো কষ্ট বেশি দিন থাকবো না।আমি কাজে গিয়া টাকা জমামু।তর ওপারেশন করামু।তুই সুস্থ হইয়া যাবি।মাইয়ারে মেট্রিক পাশ করাইয়া ভালা পোলা দেইখা বিয়া দিমু। কথা গুলো বলতে বলতে বারার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন রুমা আক্তার।
তিনি বিলাপ করে বলছিলেন,দেশের অবস্থা ভালা ছিল না।তোমারে কাজে যাইতে মানা করছিলাম।তুমি বলছিলা তোমার লগে কারো কোন শত্রুতা নাই।কেউ তোমার কোন ক্ষতি করবো না।জলদি কাজের থেইকা ফিরা আইবা।তুমিতো আর ফিরা আইলানা।আমরা কই যামু,কি করমু,কে আমাগো দেখবো!
ঘটনার ১৪ দিন পেরিয়ে যাচ্ছে এখনো যেনো শোক কাটছে না রিয়াজুলের পরিবারে।প্রতিদিন তাদের বাড়িতে মানুষ জন আসছেন।রুমা ও তার মেয়েকে শান্তনা দিচ্ছেন।কোন স্বান্তনাই যেনো রিয়াজুলের স্ত্রী ও মেয়েকে শান্ত করতে পারছে না। বাবার স্মৃতি মনে করতেই কেদে উঠছিল খুকু আক্তার।
খুকুর সঙ্গে কথা হলে সে বলেন,আমার বাবা খেটে খাওয়া মানুষ ছিলেন।পাইপ ফিটিংয়ের কাজ করতেন।কাজ না থাকলে অটোরিকশা চালাতেন। সেদি যখন সুপার মার্কেট গোলাগুলি শুরু হয় বাবা বাড়ি চলে আসতে চেয়েছিলেন।আ.লীগের লোকজন বাবাকে আন্দোলনকারী ভেবে মাথায় ও পেটে গুলি করে দেয়।বাবাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায় স্থানীয়রা।পরে শুনি আমার বাবা মারা গেছে।আমি আমার বাবার হত্যার বিচার চাই।
প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয়রা জানান, ৪ আগস্ট রোববার সকাল থেকে শহরের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা। সকাল পৌনে ১০টার দিকে তাঁরা শহরের সুপারমার্কেট এলাকায় আসলে পুলিশের উপস্থিতিতে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা শিক্ষার্থীদের পেটানো শুরু করেন।
আন্দোলনকারীরা শহরের হাটলক্ষ্মীগঞ্জ এলাকার সড়ক দিয়ে সুপারমার্কেট এলাকায় আসতে চাইলে জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ফয়সাল মৃধা,শহর ছাত্রলীগের সভাপতি নসিবুল ইসলাম,সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ সাগর,শহর সদর উপজেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সামসুল কবির মাস্টার, শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সহ সদর উপজেলার মোল্লাকান্দি, শিলই ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বন্ধুক, ছুড়ি,ককটেল নিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালান। আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ তাঁদের লক্ষ্য করে কাঁদানে গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট ছোড়ে। এতে দেড় সাংবাদিক সহ শতাধিক আন্দোলনকারী গুলিবিদ্ধ হন। এবং রিয়াজুল ফরাজীসহ তিনজন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।
নিহত রিয়াজুলের মেঝো ভাই আজিজুল ফরাজী সেদিনের ঘটনার বর্ণণা দিয়ে বলেন,যেদিন রিয়াজুল মারা যায় আমরা পুলিশ ও আ.লীগের সন্ত্রাসীদের ভয়েওর লাশটা পর্যন্ত দেখতে যেতে পারিনি।ভাইতো মারাই গেছে,দেশের যে পরিস্থিতি ছিল তাতে আমাদেরকেও হয়রানি করা হচ্ছিলো।৪ আগস্ট আ.লীগের লোকজন নিয়ে পুলিশ বাড়ি বাড়ি এসে শাসিয়ে গিয়েছিল।পর দিন পাঁচ আগস্ট যখন শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালায়, সেদিন ভাইয়ের লাশ মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের মর্গ থেকে বাড়িতে এনেছিলাম।
নিহতের বড় ভাই জিয়াউর রহমান ফরাজী বলেন,
আমার ভাই তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিল। সে মারা যাওয়াতে পুরো পরিবারটি এখন অসহায় হয়ে পড়েছে। আমরাও দিনমজুর মানুষ, দিন আনি দিন খাই। আমরা তো আমাদের পেট ঠিকমতো চালাতে পারি না। এখন ওদের কি করে দেখব! আমরা চাই রিয়াজুল হত্যার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিচার হোক এবং বর্তমান সরকার যেন এই পরিবারটির পাশে এসে দাঁড়ায়।
সহযোগিতার ব্যাপারে মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তা (ইউএনও) আফিফা খাঁন, হতাহতদের সহযোগিতার ব্যাপারে এখনও সরকারি কোনো নির্দেশনা আসেনি। সরকারের পক্ষ থেকে যদি তাদের জন্যে বরাদ্দ হয়, সেই বরাদ্দ পেলে অবশ্যই তাদেরকে সহযোগিতা করা হবে।